হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর জীবনী -মাইকেল এইচ. হার্ট শ্রেষ্ঠ ১০০ মনীষীর জীবনী
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ইসলামের সর্বশেষ নবী এবং তাঁর উপর কুরআন নাজিল করা হয়েছে, যা মুসলমানদের জন্য পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। হযরত মুহাম্মদ সাঃ ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে মদিনায় ইন্তেকাল করেন।
হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর জীবনী: শুরু
যে মহামানবের সৃষ্টি না হলে এই পৃথিবীর কিছুই তৈরি হতো না, যার আগমনে পৃথিবী ধন্য হয়েছে; আল্লাহর প্রতি গভীর বিশ্বাস, অন্তরের পবিত্রতা, আত্মার শ্রেষ্ঠত্ব, ধৈর্য, ক্ষমাশীলতান্যায়বিচার এবং দায়িত্বশীলতা যার চরিত্রের বিশেষ গুণ I তিনি সফল ব্যবসায়ী,প্রতিভাবান রাজনীতিবিদ দক্ষ রাষ্ট্রনায়ক। তিনি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মহামানব, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)। তিনি এমন এক সময়ে পৃথিবীতে এসেছিলেন যখন আরবের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও নৈতিক অবস্থার চরম অবনতি হয়েছিল।
হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর জীবনী: শিশুকাল
৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগস্ট মোতাবেক ১২ রবিউল আউয়াল রোজ সোমবার প্রত্যুষে আরবের মক্কা নগরীতে সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশে মাতা আমেনার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। জন্মের ৫ মাস পূর্বে পিতা আবদুল্লাহ ইন্তেকাল করেন। আরবের তৎকালীন অভিজাত পরিবারের প্রথানুযায়ী তাঁর লালন-পালন ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব অর্পিত হয় বনী সা’দ গোত্রের বিবি হালিমার উপর। এ সময় বিবি হালিমার আরেক পুত্র সন্তান ছিল, যার দুধ পানের মুদ্দত তখনো শেষ হয়নি। বিবি হালিমা বর্ণনা করেন, “শিশু মুহাম্মদ কেবলমাত্র আমার ডান স্তরের দুধ পান করত । আমি তাঁকে আমার বাম স্তনের দুধ দান করতে চাইলেও, তিনি কখনো বাম স্তন হতে দুধ পান করতেন না। আমার বাম স্তনের দুধ তিনি তাঁর অপর দুধ ভাইয়ের জন্যে রেখে দিতেন। দুধ পানের শেষ দিবস পর্যন্ত তাঁর এ নিয়ম বিদ্যমান ছিল।” ইনসাফ ও সাম্যের মহান আদর্শ তিনি শিশুকালেই দেখিয়েছেন। মাত্র ৫ বছর তিনি ধাত্রী মা হালিমার তত্ত্বাবধানে ছিলেন। এরপর ফিরে আসেন মাতা আমেনার গৃহে। ৬ বছর বয়সে তিনি মাতা আমেনার সাথে পিতার কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে মদীনা যান এবং মদীনা হতে প্রত্যাবর্তনকালে ‘আবহাওয়া’ নামক স্থানে মাতা আমেনা ইন্তেকাল করেন। এরপর ইয়াতীম মুহাম্মদ (সাঃ) এর লালন-পালনের দায়িত্ব অর্পিত হয় ক্ৰমান্বয়ে দাদা আবদুল মোত্তালিব ও চাচা আবু তালিবের উপর । পৃথিবীর সর্ব শ্রেষ্ঠ যে মহামানব আবির্ভূত হয়েছেন সারা জাহানের রহমত হিসেবে; তিনি হলেন আজন্ম ইয়াতীম এবং দুঃখ বেদনার মধ্য দিয়েই তিনি গড়ে উঠেন সত্যবাদী, পরোপকারী এবং আমানতদারী হিসেবে। তাঁর চরিত্র, আমানতদারী, ও সত্যবাদিতার জন্যে আরবের কাফেররা তাঁকে, ‘আল আমীন’ অর্থাৎ ‘বিশ্বাসী’ উপাধিতে ভূষিত করেছিল । তৎকালীন আরবে অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা, হত্যা, যুদ্ধবিগ্রহ ইত্যাদি ছিল নৈমিত্তিক ব্যাপার। ‘হরবে ফুজ্জার’ এর নৃশংসতা বিভীষিকা ও তান্ডবলীলা দেখে বালক মুহাম্মদ (সাঃ) দারুণভাবে ব্যথিত হন এবং ৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ১৪ বছর বয়সে চাচা হযরত যুবায়ের (রাঃ) ও কয়েকজন যুবককে সাথে নিয়ে অসহায় ও দুর্গত মানুষদের সাহায্যার্থে এবং বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে শান্তি, শৃঙ্খলা ও ভ্রাতৃত্ববোধ প্রতিষ্ঠার দীপ্ত অংগীকার নিয়ে গডে
হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর জীবনী: সংগঠন
তোলেন ‘হিলফুল ফুজুল’ নামক একটি সমাজ সেবামূলক সংগঠন। বালক মুহাম্মদ (সাঃ) ভবিষ্যত জীবনে যে শান্তি স্থাপনের অগ্রদূত হবেন এখানেই তার প্রমাণ মেলে ।
হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর জীবনী: বিবাহ
যুবক মুহাম্মদ (সাঃ) এর সততা, বিশ্বস্ততা, চিন্তা চেতনা, কর্ম দক্ষতা ও ন্যায় পরায়ণতায় মুগ্ধ হয়ে তৎকালীন আরবের ধনাঢ্য ও বিধবা মহিলা বিবি খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ বিবাহের প্রস্তাব দেন। এ সময় বিবি খাদিজার বয়স ছিল ৪০ বছর এবং হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর বয়স ছিল ২৫ বছর। তিনি চাচা আবু তালিবের সম্মতিক্রমে বিবি খাদিজার প্রস্তাব গ্রহণ করেন। বিবাহের পর বিবি খাদিজা তাঁর ধন-সম্পদ হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর হাতে তুলে দেন। কিন্তু তৎকালীন আরবের কাফের, মুশরিক, ইহুদি, নাসারা ও অন্যান্য ধর্ম মতাবলম্বীদের অন্যায়, জুলুম, অবিচার, মিথ্যা, ও পাপাচার দেখে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর হৃদয় দুঃখ বেদনায় ভরে যেতে এবং পৃথিবীতে কিভাবে ইনসাফ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা যায়, সে চিন্তায় তিনি প্রায়ই মক্কার অনতিদূরে ‘হেরা’ নামক পর্বতের গুহায় ধ্যানমগ্ন থাকতেন। বিবি খাদিজা স্বামীর মহৎ প্রতিভা ও মহান ব্যক্তিত্ব উপলব্ধি করতে পেরে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে নিশ্চিত মনে অবসর সময় ‘হেরা’ পর্বতের গুহায় ধ্যানমগ্ন থাকার পূর্ণ সুযোগ দিয়েছিলেন। ক্রমান্বয়ে তাঁর বয়স যখন ৪০ বছর পূর্ণ হয় তখন তিনি নবুয়্যত লাভ করেন এবং তাঁর উপর সর্ব প্রথম নাজিল হয় পবিত্র কোরআনের সূরা-আলাকের প্রথম কয়েকটি আয়াত। এরপর সুদীর্ঘ ২৩ বছরে বিভিন্ন ঘটনা ও প্রয়োজন অনুসারে তাঁর উপর পূর্ণ ৩০ পারা কোরআন শরীফ নাজিল হয় ।
হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর জীবনী : নবুয়্যত প্রাপ্তপর
নবুয়্যত প্রাপ্তির পর প্রথম প্রায় ৩ বছর তিনি গোপনে স্বীয় পরিবার ও আত্মীয়ের মধ্যে ইসলামের দাওয়াত প্রচার করেন। সর্ব প্রথম ইসলাম কবুল করেন বিবি খাদিজা (রাঃ) এরপর.. যখন তিনি প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার শুরু করেন এবং ঘোষণা করেন, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ’ তখন মক্কার কুরাইশ কাফেররা তাঁর বিরোধিতা করতে শুরু করে। এতদিন বিশ্বনবী (সাঃ) কুরাইশদের নিকট ছিলেন ‘আল আমীন’ হিসেবে পরিচিত; কিন্তু এ ঘোষণা দেয়ার পর তিনি হলেন কুরাইশ কাফেরদের ভাষায় একজন জাদুকর ও পাগল। যেহেতু কোরআন আরবী ভাষায় নাজিল হয়েছে এবং আরববাসীদের ভাষাও ছিল আরবী, তাই তারা হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর বাণীর মর্মার্থ অনুধাবন করতে পেরেছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল যে, মুহাম্মদ (সাঃ) যা প্রচার করছেন তা কোন সাধারণ কথা নয়। যদি এটা মেনে নেয়া হয় তাহলে তাদের ক্ষমতার মসনদ টিকে থাকবে না। তাই তারা হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে বিভিন্ন ভয়, ভীতি, হুমকি; এমনকি ধন-দৌলত ও আরবের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী যুবতী নারীদের দেবার লোভ দেখাতে শুরু করে। মুহাম্মদ (সাঃ) কাফিরদের শত ষড়যন্ত্র ও ভয়-ভীতির মধ্যেও ঘোষণা করলেন, “আমার ডান হাতে যদি সূর্য আর বাম হাতে চাঁদ ও দেয়া হল, তবু আমি সত্য প্রচার থেকে বিরত থাকব না।” কাফিরদের কোন লোভ লালসা বিশ্বনবী (সাঃ) কে ইসলাম প্রচার থেকে বিন্দুমাত্র বিরত রাখতে পারেনি। মক্কায় যারা পৌত্তলিকতা তথা মূর্তি পূজা ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস স্থাপন করেছিল কুরাইশরা তাঁদের উপর অবর্ণনীয় নির্যাতন, শুরু করে। কিন্তু ইসলামের শাশ্বত বাণী যারা একবার গ্রহণ করেছে তাঁদেরকে শত নির্যাতন করেও ইসলাম থেকে পৌত্তলিকতায় ফিরিয়ে নিতে পারেনি ।
হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর জীবনী :বিবি খাদিজা এবং আবু তালিব ইন্তেকাল
৬২০ খ্রিস্টাব্দে বিবি খাদিজা (রাঃ) এবং আবু তালিব একই বছরে ইন্তেকাল করেন, যা ইসলামের ইতিহাসে “আমুল হুজুন” বা শোকের বছর হিসেবে পরিচিত।। জীবনের এ সংকটময় মুহূর্তে তাঁদেরকে হারিয়ে বিশ্বনবী (সাঃ) শোকে দুঃখে মুহ্যমান হয়ে পড়েন। বিবি খাদিজা ছিলেন বিশ্বনবীর দূরসময়ের স্ত্রী, উপদেষ্টা এবং বিপদ আপদে সান্ত্বনা স্বরূপ । চাচা আবু তালিব ছিলেন শৈশবের অবলম্বন, যৌবনের অভিভাবক এবং পরবর্তী নবুয়াত জীবনের একনিষ্ঠ সমর্থক। ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি স্বীয় পালিত পুত্র হযরত যায়েদ বিন হারেসকে সংগে নিয়ে তায়েফ গমন করলে সেখানেও তিনি তায়েফবাসী কর্তৃক নির্যাতিত হন। তায়েফবাসীরা প্রস্তারাঘাতে বিশ্বনবীকে জর্জরিত করে ফেলে।
হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর জীবনী :‘হুদায়বিয়ার সন্ধি’
৬২৭ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ষষ্ঠ হিজরীতে ১৪০০ নিরস্ত্র সাহাবীকে সঙ্গে নিয়ে মুহাম্মদ (সাঃ) মাতৃভূমি দর্শন ও পবিত্র হজ্জ পালনের উদ্দেশ্যে মক্কা রওনা দেন। কিন্তু পথিমধ্যে কুরাইশ বাহিনী কর্তৃক বাঁধাপ্রাপ্ত হয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে একটি সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যা ইসলামের ইতিহাসে ‘হুদায়বিয়ার সন্ধি’ নামে পরিচিত। সন্ধির শর্তাবলীর মধ্যে এ কথাগুলো ও উল্লেখ ছিল যে -(১) মুসলমানগণ এ বছর ওমরা আদায় না করে ফিরে যাবে, (২) আগামী বছর হজ্জে আগমন করবে, তবে ৩ দিনের বেশি মক্কায় অবস্থান করতে পারবে না, (৩) যদি ান কাফির স্বীয় অভিভাবকের অনুমতি ব্যতীত মুসলমান হয়ে মদীনায় গমন করে তাহলে কে মক্কায় ফিরিয়ে দিতে হবে। পক্ষান্তরে মদীনা হতে যদি কোন ব্যক্তি পলায়ন পূর্বক মক্কায় ল আসে তাহলে তাকে ফিরিয়ে দেয়া হবে না, (৪) প্রথম থেকে যে সকল মুসলমান মক্কায় সবাস করছে তাদের কাউকে সাথে করে মদীনায় নিয়ে যাওয়া যাবে না। আর সলমানগণের মধ্যে যারা মক্কায় থাকতে চায় তাদেরকে বিরত রাখা যাবে না । (৫) আরবের বিভিন্ন গোত্রগুলোর এ স্বাধীনতা থাকবে যে, তারা উভয় পক্ষের (মুসলমনি ও কাফির) মাঝে যাদের সঙ্গে ইচ্ছে সংযোগ স্থাপন করতে পারবে, (৬) সন্ধিচুক্তির মেয়াদের মধ্যে উভয় পক্ষ শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে যাতায়াতের সম্পর্ক চালু রাখতে পারবে। এছাড়া কুরাইশ প্রতিনিধি সুহায়েল বিন আমার সন্ধিপত্র থেকে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ এবং ‘মুহাম্মদুর রাসূলল্লাহ’ বাক্য দু’টি কেটে দেয়ার জন্যে দাবি করেছিল। কিন্তু সন্ধি পত্রের লেখক হযরত আলী (রাঃ) তা মেনে নিতে রাজি হলেন না। অবশেষে বিশ্বনবী (সাঃ) সুহায়েল বিন আমরের আপত্তির প্রেক্ষিতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানীর রাহীম’ এবং ‘মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ’ বাক্য দু’টি নিজ হাতে, কেটে দেন এবং এর পরিবর্তে সুহায়েল বিন আমরের দাবি অনুযায়ী ‘বিছমিকা অপমানজনক হলেও তা মুহাম্মদ (সাঃ) কে অনেক সুযোগ সুবিধা ও সাফল্য এনে দিয়েছিল। এ সন্ধির মাধ্যমে কুরাইশরা মুহাম্মদ (সাঃ) এর রাজনৈতিক সত্তাকে একটি স্বাধীন সত্তা হিসেবে স্বীকার করে নেয়। সন্ধির শর্তানুযায়ী অমুসলিমগণ মুসলমানদের সাথে অবাধে মেলামেশার সুযোগ পায়। ফলে অমুসলিমগণ ইসলামের মহৎ বাণী উপলব্ধি করতে থাকে এবং দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে। এ সন্ধির পরই মুহাম্মদ (সাঃ) বিভিন্ন রাজন্যবর্গের নিকট ইসলামের দাওয়াত দিয়ে পত্র প্রেরণ করেন এবং অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করেন। মুহাম্মদ (সাঃ) যেখানে মাত্র ১৪০০ মুসলিম সৈন্য নিয়ে হুদায়বিয়াতে গিয়েছিলেন, সেখানে মাত্র ২ বছর অর্থাৎ অষ্টম হিজরীতে ১০,০০০ মুসলিম সৈন্য নিয়ে বিনা রক্তপাতে মক্কা জয় করেন। যে মক্কা থেকে বিশ্বনবী (সাঃ) নির্যাতিত অবস্থায় বিতাড়িত রাজনৈতিক ব্যক্তির, সেখানে আজ তিনি বিজয়ের বেশে উপস্থিত হলেন এবং মক্কাবাসীদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেন। মক্কা বিজয়ের দিন হযরত ওমর ফারুক (রাঃ) কুরাইশ নেতা আবুসুফিয়ানকে গেফতার করে মুহাম্মদ (সাঃ) এর সম্মুখে উপস্থিত করেন। কিন্তু তিনি তাঁর দীর্ঘদিনের শত্রুকে হাতে পেয়েও ক্ষমা করে দেন। ক্ষমার এ মহান আদর্শ পৃথিবীর ইতিহাসে আত্মও বিরল। মক্কায় আজ ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডিয়মান। সকল অন্যায় অসত্য, শোষণ ও জুলুমের রাজত্ব চিরতরে বিলুপ্ত।
বিদায় হজ্জের চাষণ
৬৩১ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক দশম হিজরীতে মুহাম্মদ (সাঃ) লক্ষাধিক মুসলিম সৈন্য নিয়ে বিদায় হজ্জ সম্পাদন করেন এবং হজ্জ শেষে আরাফাতের বিশাল ময়দানে প্রায় ১,১৪,০০০ সাহাবীর সম্মুখে জীবনের অন্তিম ভাষণ প্রদান করেন যা ইসলামের ইতিহাসে “বিদায় হজ্জের চাষণ” নামে পরিচিত। বিদায় হজ্জের ভাষণে বিশ্বনবী (সাঃ) মানবাধিকার সম্পর্কিত যে সনদপত্র ঘোষণা করেন দুনিয়ার ইতিহাসে তা আজও অতুলনীয়। তিনি দীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, (১) হে বন্ধুগণ, স্মরণ রেখ, আজিকার এ দিন, এ মাস এবং এ পবিত্র নগরী তোমাদের নিকট যেমন পবিত্র, তেমনি পবিত্র তোমাদের সকলের জীবন, তোমাদের ধন- সম্পদ, রক্ত এবং তোমাদের মান-মর্যাদা তোমাদের পরস্পরের নিকট। কখনো অন্যের উপর অন্যায় ভাবে হস্তক্ষেপ করবে না। (২) মনে রেখ, স্ত্রীদের উপর তোমাদের যেমন অধিকার আছে, তোমাদের উপর ও স্ত্রীদের তেমন অধিকার আছে। (৩) সাবধান, শ্রমিকের ঘাম শুকাবার পূর্বেই তার উপযুক্ত পারিশ্রমিক পরিশোধ করে দিবে। (৪) মনে রেখ, যে পেট ভরে খায় অথচ তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে সে প্রকৃত মুসলমান হতে পারে না। (৫) চাকর চাকরাণীদের প্রতি নিষ্ঠুর হইও না। তোমারা যা খাবে, তাদেরকে তাই খেতে দিবে; তোমরা যা পরিধান করবে, তাদেরকে তাই (সমমূল্যের) পরিধান করতে দিবে। (৬) কোন অবস্থাতেই ইয়াতীমের সম্পদ আত্মসাৎ করবে না। এমনি ভাবে মানবাধিকার সম্পর্কিত বহু বাণী তিনি বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে পেশ করে যান। তিনি হলেন উত্তম চরিত্রের অধিকারী, মানবজাতির একমাত্র আদর্শ এবং বিশ্ব জাহানের রহমত হিসেবে প্রেরিত।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর নবুয়্যতের ২৩ বছরের আন্দোলনে আরবের একটি অসভ্য ও বর্বর জাতিকে একটি সভ্য ও সুশৃঙ্খল জাতিতে পরিণত করেছিলেন। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে আমূল সংস্কার সাধিত হয়। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে চিরাচরিত গোত্রীয় পার্থক্য তুলে দিয়ে, তিনি ঘোষণা করেন, ‘অনারবের উপর আরবের এবং আরবের উপর অনাররের; কৃষ্ণাঙ্গের উপর শ্বেতাঙ্গের এবং শ্বেতাঙ্গের উপর কৃষ্ণাঙ্গের কোন পার্থক্য নেই। বরং তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি উত্তম যে অধিক মুত্তাকিন। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তিনি সুদকে সম্পূর্ণ ভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং যাকাত ভিত্তিক অর্থনীতির মাধ্যমে এমন একটি অর্থ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যেখানে রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিক তাদের আর্থিক নিরাপত্তা লাভ করেছিল । সামাজিক ক্ষেত্রে নারীর কোন মর্যাদা ও অধিকার ছিল না । বিশ্বনবী (সাঃ) নারী জাতিকে সর্বোচ্চ মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করলেন এবং ঘোষণা করলেন “মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত।” নারী জাতিকে শুধু মাত্র মাতৃত্বের মর্যাদাই দেননি, উত্তরাধিকার ক্ষেত্রেও তাদের অধিকারকে করেছেন সমুন্নত ও সুপ্রতিষ্ঠিত। ক্রীতদাস আযাদ করাকে তিনি উত্তম ইবাদত বলে ঘোষণা করেন। ধর্মীয় ক্ষেত্রে যেখানে মূর্তিপূজা, অগ্নিপূজা এবং বিভিন্ন বস্তুর পূজা আরববাসীদের জীবনকে কলুষিত করেছিল সেখানে তিনি আল্লাহর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করেন। মুদ্দ কথা তিনি এমন একটি অপরাধমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন যেখানে কোন হানাহানি, রাহাজানি, বিশৃঙ্খলা, শোষণ, জুলুম, অবিচার, ব্যভিচার, সুদ ঘুষ ইত্যাদি ছিল না ।
ইন্তেকাল
অবশেষে এ মহামানব ১২ রবিউল আউয়াল, ১১ হিজরী মোতাবেক ৭ জুন, ৬৩২ খ্রিঃ ৬৩ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন । তিনি হলেন সর্বশেষ নবী ও রাসূল । পৃথিবীর বুকে কিয়ামত পর্যন্ত আর কোন নবীর আবির্ভাব হবে না। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) গোটা মুসলিম জাতিকে উদ্দেশ্য করে বলে গিয়েছেন, “আমি তোমাদের জন্যে দু’টি জিনিস রেখে গেলাম । যতদিন তোমরা এ দু’টি জিনিসকে আঁকড়ে রাখবে ততদিন তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। একটি হল আল্লাহর কিতাব অর্থাৎ কোরআন আর অপরটি হল আমার সুন্নাহ অর্থাৎ হাদিস। বিশ্বনবী (সাঃ) এর জীবনী লিখতে গিয়ে খ্রিস্টান লেখক ঐতিহাসিক উইলিয়াম মুর বলেছেন, “He was the mater mind not only of his own gae but of all ages” মুহাম্মদ (সাঃ) যে যুগে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন তাকে শুধু সে যুগেরই একজন মনীষী বলা হবে না, বরং তিনি ছিলেন সর্বকালের, সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মনীষী